পাবলিক পরীক্ষা নকলের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার পর নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরীক্ষায় নকল নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক সমাপনী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ নিয়ে শিক্ষাবিদ-অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন হলেও শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকারই করতে নারাজ। পরীক্ষার আগের দিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হুবহু ছাপিয়ে দিলেও মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট বোর্ড চেয়ারম্যানদের এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ ছিল না।
পাবলিক পরীায় যেভাবে পাল্লা দিয়ে ‘মেধার বিস্ফোরণ’ ঘটছে, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই বছরেই শতভাগে পৌঁছবে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীা পাসের হার। প্রায় একই অবস্থা জেএসসি-জেডিসিরও। এসএসসি ও এইচএসসির শতভাগ পাস হতেও বেশি দেরি নেই। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, শিার সংখ্যাগত সূচকে রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে গুণগত মানের দিকটি। গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়টি বছরের পর বছর উপেতি হওয়ায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পুরো শিাব্যবস্থাই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন সবারই মনে। সম্প্রতি সরকারের শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার মান উন্নত করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ১০ বছর লেখাপড়ার পর কোনো শিক্ষার্থী ফেল করলে তাকে কি পড়ানো হলো?
বাংলাদেশের শিার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্বব্যাংক বলছে, ভর্তির হার বাড়লেও কমছে শিার মান। সমাপনী পরীায় উত্তীর্ণদের শতকরা ৭৫ জন বাংলাতেই দ নয়। ইংরেজি ও গণিতের অবস্থা আরো করুণ। মানের সঙ্কটের এখানেই শেষ নয়, গেল বছর উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ পাওয়া শিার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীায় ন্যূনতম পাস নম্বরই পায়নি। এমন অবস্থা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম পর্ব পরীায় ৪৬ শতাংশই ফেল করেছে, যাদের অর্ধেকই ফেল করেছে অন্তত পাঁচ বিষয়ে। এক সময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি নিয়ে সুনাম অর্জন করলেও এখন র্যাংকিংয়ে বিশ্বের কোনো তালিকাতেই স্থান পায় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, শিােেত্র দুর্নীতির ফলে সেবাগ্রহীতার জন্য শিার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, অবনতি ঘটেছে শিার মানে। দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিার মানের সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে আরো বলছে, বাংলাদেশে শিােেত্র শিকদের পর্যাপ্ত প্রশিণ বা ক্যারিয়ার সহায়ক সুযোগ-সুবিধা নেই। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব এবং সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা ও সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহমূলক উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না, যার ফল ভোগ করছেন শিার্থীরা।
পাবলিক পরীায় ফি-বছর রেকর্ড পাসের হার নিয়ে ‘আত্মতুষ্টির’ কিছু নেই উল্লেখ করে বিশিষ্ট শিাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিা পর্যন্ত শিার মানে এক ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে।
উদারভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশ : ফেল করলে পাস নম্বর ও উদারভাবে এসএসসি এবং সমমান পরীার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশ দেয়া হয় পরীকদের। একটি প্রশ্নের কিছু অংশ লিখলেও পুরো নম্বর দেয়ার নির্দেশ থাকে। পরীা শেষ হওয়ার পর উত্তরপত্র বিতরণের সময় সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে প্রধান পরীক ও সহকারী পরীকদের নিয়ে করা বৈঠকে এ ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বোর্ডের একজন প্রধান পরীক বলেন, আমার নেতৃত্বে প্রায় আট হাজারের বেশি উত্তরপত্র মূল্যায়ন হয়েছে। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পারিনি। তিনি বলেন, ওইসব উত্তরপত্রে একজনও ফেল করেনি। আমাদের আগেই নির্দেশ দেয়া হয়Ñ ‘ফেল করলে পাস নম্বর দিতে।’ এ ছাড়া একটু লিখলেও পুরো নম্বর দিতে বলা হয়। এ কারণেই আকাশচুম্বী ফল হয়েছে। ওই পরীক বলেন, বোর্ডের নির্দেশ মতো কাজ না করলে আমাদের নানা সমস্যা আছে। পরের বছর আর উত্তরপত্র দেয়া হবে না, পদোন্নতি হবে না এবং নানাভাবে হয়রানি করা হবে। তিনি বলেন, এভাবে শিাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
দিনাজপুর বোর্ডের একজন প্রধান পরীক বলেন, এবারের ফল ভালো হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত সহানুভূতির দৃষ্টিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া কোনোমতে উত্তর লিখলেও তাতে নম্বর দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে ফল ভালো হচ্ছে কিন্তু শিার্থীদের ধ্বংস ডেকে আনা হচ্ছে। শিার্থীরা আগের মতো পড়ালেখা করবে না। মনে করবে একটু লিখলেই নম্বর দেয়া হয়।
ইংরেজি বিভাগের একজন প্রধান পরীক্ষক জানান, তার নেতৃত্বে এসএসসি পরীক্ষার চার হাজার ২০০ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনও ফেল করেনি। এটা কি করে সম্ভব? জানতে চাইলে এ পরীক্ষক বলেন, কোনো শিক্ষার্থী ফেল করলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্নজনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এরপর আগামীতে উত্তরপত্র না পাওয়া আশঙ্কা থেকে যায়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো পরীক্ষক ১০০-এর মধ্যে ১০০ দিয়ে দিলেও কোনো জবাব দিতে হয় না। নম্বর বেশি দিলে কোনো প্রশ্ন নেই। কম নম্বর দিলেই যত সমস্যা। উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে কেবল নম্বরই দেয়া হচ্ছে। এতে পাস ও জিপিএ ৫ বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। সরকারি একটি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, সরকার ইচ্ছা করেই পাসের হার এবং জিপিএ ৫ বাড়াচ্ছে। এর দায় পুরোপুরি শিক্ষামন্ত্রীকে নিতে হবে। আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমাদের যেভাবে নির্দেশ দেয়া হয় সেভাবেই কাজ করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষায় বেশি ফেল করে জিপিএ ৫ প্রাপ্তরা: ২০১২-১৩ শিাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীনে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তিপরীায় জিপিএ ৫ পাওয়া ৭৫ ভাগ ফেল করেছে। দুই হাজার ২৭৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তিপরীা দিয়েছিল ৩৮ হাজার ৩৭৪ জন পরীার্থী। যাদের পাঁচ হাজার ৯০১ জন জিপিএ ৫ পাওয়া। পাস করেছে মাত্র ১৪৫৪ জন। ‘খ’ ইউনিটে ১২০ নম্বরের পরীায় উত্তীর্ণ হতে হলে একজন পরীার্থীকে কমপে ৪৮ নম্বর পেতে হবে। ২০১০ ও ২০১১ সালে এ হার ছিল ৬৮ ও ৫৬ ভাগ।
বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ‘ক’ ইউনিটে ফেলের হার ৫১ ভাগ। ৬২ হাজার ১২০ জন শিার্থী ভর্তিপরীা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৩০ হাজার ৯১৪ জন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১৫ হাজার ১২৭ জন। বাকি ৫১ ভাগ পরীার্থী পাসই করতে পারেনি। ২০১০ ও ২০১১ সালের ভর্তিপরীায় ৩৫ ও ৪২ ভাগ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে সব বিষয়ে জিপিএ ৫ (গোল্ডেন জিপিএ) পাওয়া ৭১০২ জন পরীার্থীর মধ্যে ২২২৭ জনই পাসই করতে পারেনি। বাণিজ্য অনুষদের অধীনে ‘গ’ ইউনিটে ফেলের হার ৫৮ ভাগ, ‘ঘ’ ইউনিটে ফেলের হার ৯০ ভাগ। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই হার ছিল ৫২ ও ৬২ ভাগ।
শিাবিদদের বক্তব্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এসএসসি ও এইচএসসির ফল নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভালো ফল হলেও ভালো লেখাপড়া হচ্ছে না। সবকিছু হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনৈতিক চিন্তা থেকেই জিপিএ ৫ এবং পাসের হার বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না। প্রবীণ এ শিাবিদ বলেন, ১০০ ভাগ ফল হলেই কি লাভ? যদি শিার্থীদের ভালোভাবে পড়ালেখা শেখানো না হয়, এসব করে কিছু লাভ হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর কারণে শিার্থীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা বেড়েছে। এ ছাড়া শিকদের প্রশিণ দেয়ায় তাদের মধ্যেও বিচণতা এসেছে। তিনি বলেন, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় এত নম্বর কি শিার্থীরা আসলেই পেয়েছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন বলেন, শিার্থীদের লেখাপড়া না শিখিয়েই এখন পাস করানো হচ্ছে। শিকদের বলা হচ্ছে যা লেখে তাতেই নম্বর দেন। জিপিএ ৫ এখন রাজনৈতিক বিষয় হয়ে গেছে। যে সরকারের আমলে যত বেশি জিপিএ ৫ সে সরকার তত বেশি ক্রেডিট নিচ্ছে। কিন্তু শিার্থীরা যে পড়ালেখা শিখছে না এটা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিপরীক্ষা দিলে ৩২ হাজার ফেল করে। পাস নম্বর আটও পায় না। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে এখনকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। ফলে তারা কিছুই শিখছে না। এতে করে শিক্ষার মান কমেছে। সরকারের দুর্বলতার কারণে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। একটু সচেতন হলেই এটা প্রতিরোধ সম্ভব। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের দাবি জানান তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পাসের হারের মতো ঢালাওভাবে মান বেড়েছে এটা বলা যাবে না। পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার মান নির্ণয় করা যায় না। এটা নিশ্চিত হওয়া যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের উপকরণ আছে কি না। প্রাথমিকে সৃজনশীল বিষয়ে ২০ ভাগ দক্ষতা অর্জন হয়েছে। দক্ষতা না থাকলে মান বেড়েছে তা বলা যাবে না। প্রশ্ন ফাঁস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। অসাধু চক্র এটি করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারকারীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছে, যা একেবারে অনৈতিক। এভাবে কোনো প্রজন্ম বেড়ে উঠলে তা ভালো কিছু অর্জন করবে না বলে তিনি মনে করেন।
শিামন্ত্রীর বক্তব্য : শিামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সার্বিক শিার উন্নয়নের কারণেই ফল ভালো হচ্ছে। আগের ধারার শিা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এখন আর নোটবই পড়ে ভালো নম্বর পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আমরা পাঁচ লাখ শিককে প্রশিণ দিয়েছি। তারা এখন অনেক বেশি দ। শ্রেণিকে মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম চালু হয়েছে। ফলে শিার্থীরা শ্রেণিকে বসেই দেখতে পাচ্ছে কোথায় কী ঘটছে। আগে অনেক ছেলেমেয়ে বই কিনতে পারত না। এখন আমরা কোটি কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করছি। এটা শিা েেত্র একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন।
বোর্ডের বক্তব্য : আন্তঃশিা বোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেন, পরীকদের কয়েক প্রকার নির্দেশ দেয়া হলেও বেশি নম্বর দেয়ার কথা বলা হয় না। তবে দুই দফা নির্দেশনা থাকে। প্রথমত আমরা বলে থাকি আপনারা ভুলকে সঠিক ভেবে নম্বর দেবেন না। দ্বিতীয়ত কোন শ্রেণীর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন তা বিবেচনায় রেখে নম্বর দেবেন। সম্প্রতি ফল ভালো করার পেছনে সৃজনশীল পদ্ধতি ও শিকদের প্রশিণকে প্রধান কারণ মনে করেন তিনি।
পাবলিক পরীায় যেভাবে পাল্লা দিয়ে ‘মেধার বিস্ফোরণ’ ঘটছে, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই বছরেই শতভাগে পৌঁছবে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীা পাসের হার। প্রায় একই অবস্থা জেএসসি-জেডিসিরও। এসএসসি ও এইচএসসির শতভাগ পাস হতেও বেশি দেরি নেই। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, শিার সংখ্যাগত সূচকে রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে গুণগত মানের দিকটি। গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়টি বছরের পর বছর উপেতি হওয়ায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পুরো শিাব্যবস্থাই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন সবারই মনে। সম্প্রতি সরকারের শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার মান উন্নত করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ১০ বছর লেখাপড়ার পর কোনো শিক্ষার্থী ফেল করলে তাকে কি পড়ানো হলো?
বাংলাদেশের শিার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্বব্যাংক বলছে, ভর্তির হার বাড়লেও কমছে শিার মান। সমাপনী পরীায় উত্তীর্ণদের শতকরা ৭৫ জন বাংলাতেই দ নয়। ইংরেজি ও গণিতের অবস্থা আরো করুণ। মানের সঙ্কটের এখানেই শেষ নয়, গেল বছর উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ পাওয়া শিার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীায় ন্যূনতম পাস নম্বরই পায়নি। এমন অবস্থা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম পর্ব পরীায় ৪৬ শতাংশই ফেল করেছে, যাদের অর্ধেকই ফেল করেছে অন্তত পাঁচ বিষয়ে। এক সময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি নিয়ে সুনাম অর্জন করলেও এখন র্যাংকিংয়ে বিশ্বের কোনো তালিকাতেই স্থান পায় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, শিােেত্র দুর্নীতির ফলে সেবাগ্রহীতার জন্য শিার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, অবনতি ঘটেছে শিার মানে। দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিার মানের সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে আরো বলছে, বাংলাদেশে শিােেত্র শিকদের পর্যাপ্ত প্রশিণ বা ক্যারিয়ার সহায়ক সুযোগ-সুবিধা নেই। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব এবং সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা ও সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহমূলক উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না, যার ফল ভোগ করছেন শিার্থীরা।
পাবলিক পরীায় ফি-বছর রেকর্ড পাসের হার নিয়ে ‘আত্মতুষ্টির’ কিছু নেই উল্লেখ করে বিশিষ্ট শিাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিা পর্যন্ত শিার মানে এক ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে।
উদারভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশ : ফেল করলে পাস নম্বর ও উদারভাবে এসএসসি এবং সমমান পরীার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশ দেয়া হয় পরীকদের। একটি প্রশ্নের কিছু অংশ লিখলেও পুরো নম্বর দেয়ার নির্দেশ থাকে। পরীা শেষ হওয়ার পর উত্তরপত্র বিতরণের সময় সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে প্রধান পরীক ও সহকারী পরীকদের নিয়ে করা বৈঠকে এ ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বোর্ডের একজন প্রধান পরীক বলেন, আমার নেতৃত্বে প্রায় আট হাজারের বেশি উত্তরপত্র মূল্যায়ন হয়েছে। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পারিনি। তিনি বলেন, ওইসব উত্তরপত্রে একজনও ফেল করেনি। আমাদের আগেই নির্দেশ দেয়া হয়Ñ ‘ফেল করলে পাস নম্বর দিতে।’ এ ছাড়া একটু লিখলেও পুরো নম্বর দিতে বলা হয়। এ কারণেই আকাশচুম্বী ফল হয়েছে। ওই পরীক বলেন, বোর্ডের নির্দেশ মতো কাজ না করলে আমাদের নানা সমস্যা আছে। পরের বছর আর উত্তরপত্র দেয়া হবে না, পদোন্নতি হবে না এবং নানাভাবে হয়রানি করা হবে। তিনি বলেন, এভাবে শিাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
দিনাজপুর বোর্ডের একজন প্রধান পরীক বলেন, এবারের ফল ভালো হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত সহানুভূতির দৃষ্টিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া কোনোমতে উত্তর লিখলেও তাতে নম্বর দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে ফল ভালো হচ্ছে কিন্তু শিার্থীদের ধ্বংস ডেকে আনা হচ্ছে। শিার্থীরা আগের মতো পড়ালেখা করবে না। মনে করবে একটু লিখলেই নম্বর দেয়া হয়।
ইংরেজি বিভাগের একজন প্রধান পরীক্ষক জানান, তার নেতৃত্বে এসএসসি পরীক্ষার চার হাজার ২০০ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনও ফেল করেনি। এটা কি করে সম্ভব? জানতে চাইলে এ পরীক্ষক বলেন, কোনো শিক্ষার্থী ফেল করলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্নজনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এরপর আগামীতে উত্তরপত্র না পাওয়া আশঙ্কা থেকে যায়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো পরীক্ষক ১০০-এর মধ্যে ১০০ দিয়ে দিলেও কোনো জবাব দিতে হয় না। নম্বর বেশি দিলে কোনো প্রশ্ন নেই। কম নম্বর দিলেই যত সমস্যা। উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে কেবল নম্বরই দেয়া হচ্ছে। এতে পাস ও জিপিএ ৫ বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। সরকারি একটি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, সরকার ইচ্ছা করেই পাসের হার এবং জিপিএ ৫ বাড়াচ্ছে। এর দায় পুরোপুরি শিক্ষামন্ত্রীকে নিতে হবে। আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমাদের যেভাবে নির্দেশ দেয়া হয় সেভাবেই কাজ করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষায় বেশি ফেল করে জিপিএ ৫ প্রাপ্তরা: ২০১২-১৩ শিাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীনে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তিপরীায় জিপিএ ৫ পাওয়া ৭৫ ভাগ ফেল করেছে। দুই হাজার ২৭৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তিপরীা দিয়েছিল ৩৮ হাজার ৩৭৪ জন পরীার্থী। যাদের পাঁচ হাজার ৯০১ জন জিপিএ ৫ পাওয়া। পাস করেছে মাত্র ১৪৫৪ জন। ‘খ’ ইউনিটে ১২০ নম্বরের পরীায় উত্তীর্ণ হতে হলে একজন পরীার্থীকে কমপে ৪৮ নম্বর পেতে হবে। ২০১০ ও ২০১১ সালে এ হার ছিল ৬৮ ও ৫৬ ভাগ।
বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ‘ক’ ইউনিটে ফেলের হার ৫১ ভাগ। ৬২ হাজার ১২০ জন শিার্থী ভর্তিপরীা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৩০ হাজার ৯১৪ জন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১৫ হাজার ১২৭ জন। বাকি ৫১ ভাগ পরীার্থী পাসই করতে পারেনি। ২০১০ ও ২০১১ সালের ভর্তিপরীায় ৩৫ ও ৪২ ভাগ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে সব বিষয়ে জিপিএ ৫ (গোল্ডেন জিপিএ) পাওয়া ৭১০২ জন পরীার্থীর মধ্যে ২২২৭ জনই পাসই করতে পারেনি। বাণিজ্য অনুষদের অধীনে ‘গ’ ইউনিটে ফেলের হার ৫৮ ভাগ, ‘ঘ’ ইউনিটে ফেলের হার ৯০ ভাগ। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই হার ছিল ৫২ ও ৬২ ভাগ।
শিাবিদদের বক্তব্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এসএসসি ও এইচএসসির ফল নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভালো ফল হলেও ভালো লেখাপড়া হচ্ছে না। সবকিছু হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনৈতিক চিন্তা থেকেই জিপিএ ৫ এবং পাসের হার বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না। প্রবীণ এ শিাবিদ বলেন, ১০০ ভাগ ফল হলেই কি লাভ? যদি শিার্থীদের ভালোভাবে পড়ালেখা শেখানো না হয়, এসব করে কিছু লাভ হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর কারণে শিার্থীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা বেড়েছে। এ ছাড়া শিকদের প্রশিণ দেয়ায় তাদের মধ্যেও বিচণতা এসেছে। তিনি বলেন, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় এত নম্বর কি শিার্থীরা আসলেই পেয়েছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন বলেন, শিার্থীদের লেখাপড়া না শিখিয়েই এখন পাস করানো হচ্ছে। শিকদের বলা হচ্ছে যা লেখে তাতেই নম্বর দেন। জিপিএ ৫ এখন রাজনৈতিক বিষয় হয়ে গেছে। যে সরকারের আমলে যত বেশি জিপিএ ৫ সে সরকার তত বেশি ক্রেডিট নিচ্ছে। কিন্তু শিার্থীরা যে পড়ালেখা শিখছে না এটা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিপরীক্ষা দিলে ৩২ হাজার ফেল করে। পাস নম্বর আটও পায় না। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে এখনকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। ফলে তারা কিছুই শিখছে না। এতে করে শিক্ষার মান কমেছে। সরকারের দুর্বলতার কারণে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। একটু সচেতন হলেই এটা প্রতিরোধ সম্ভব। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের দাবি জানান তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পাসের হারের মতো ঢালাওভাবে মান বেড়েছে এটা বলা যাবে না। পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার মান নির্ণয় করা যায় না। এটা নিশ্চিত হওয়া যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের উপকরণ আছে কি না। প্রাথমিকে সৃজনশীল বিষয়ে ২০ ভাগ দক্ষতা অর্জন হয়েছে। দক্ষতা না থাকলে মান বেড়েছে তা বলা যাবে না। প্রশ্ন ফাঁস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। অসাধু চক্র এটি করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারকারীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছে, যা একেবারে অনৈতিক। এভাবে কোনো প্রজন্ম বেড়ে উঠলে তা ভালো কিছু অর্জন করবে না বলে তিনি মনে করেন।
শিামন্ত্রীর বক্তব্য : শিামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সার্বিক শিার উন্নয়নের কারণেই ফল ভালো হচ্ছে। আগের ধারার শিা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এখন আর নোটবই পড়ে ভালো নম্বর পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আমরা পাঁচ লাখ শিককে প্রশিণ দিয়েছি। তারা এখন অনেক বেশি দ। শ্রেণিকে মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম চালু হয়েছে। ফলে শিার্থীরা শ্রেণিকে বসেই দেখতে পাচ্ছে কোথায় কী ঘটছে। আগে অনেক ছেলেমেয়ে বই কিনতে পারত না। এখন আমরা কোটি কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করছি। এটা শিা েেত্র একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন।
বোর্ডের বক্তব্য : আন্তঃশিা বোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেন, পরীকদের কয়েক প্রকার নির্দেশ দেয়া হলেও বেশি নম্বর দেয়ার কথা বলা হয় না। তবে দুই দফা নির্দেশনা থাকে। প্রথমত আমরা বলে থাকি আপনারা ভুলকে সঠিক ভেবে নম্বর দেবেন না। দ্বিতীয়ত কোন শ্রেণীর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন তা বিবেচনায় রেখে নম্বর দেবেন। সম্প্রতি ফল ভালো করার পেছনে সৃজনশীল পদ্ধতি ও শিকদের প্রশিণকে প্রধান কারণ মনে করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment