Saturday, May 17, 2014


তাকে ঘিরে অবিশ্বাস ছিল, ছিল দাঙ্গার কলঙ্ক আর ঘৃণা। তারপরও তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের এক ঘাঞ্চি পরিবারের সন্তান মোদির কৈশোরে অনেকটা সময় কেটেছে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করে, ক্যান্টিনবয়ের কাজও করেছেন কিছু দিন। তিনি হতে চলেছেন ভারতের চতুর্দশ প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বেই তৃতীয়বারের মতো দিল্লির মসনদে যাচ্ছে বিজেপি। 
উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এই ৬৩ বছর বয়স্ক নেতা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন সেই ২০০১ সাল থেকে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, তার গতিশীল নেতৃত্বে গুজরাট পরিণত হয়েছে ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে। কৌশলী প্রচার মোদিকে দিয়েছে উন্নয়নের অগ্রদূতের ভাবমূর্তি, বিপুল জনসমর্থন।
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময়টা ছিল মোদির উত্থানের সবচেয়ে বড় অনুঘটক। ওই সময়ে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের উসকে দিয়ে তিন হাজার মুসলমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রে মোদিকে জড়িয়ে অভিযোগ করা হয়। স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ ওই দাঙ্গার কারণে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত। তার পদত্যাগের দাবি ওঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে দেন বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। আর ওই বছরে গুজরাটের নির্বাচনে মোদির জয় তাকে আবারো আলোচনায় আনে। মোদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরে তখন থেকেই।
এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণে ভারতজুড়ে তার বিরোধিতার ছিল প্রবল। কিন্তু নির্বাচনের আগে দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতির পুরনো ছক ভেঙে পরিবর্তনকামী তারুণ্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি ছিনিয়ে এনেছেন বড় জয়। 
আরএসএস থেকে মুখ্যমন্ত্রী
জন্ম ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। পারিবারিক নাম নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদি। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় মোদি স্কুলজীবনে ছাত্র হিসেবে ছিলেন মাঝারি মানের। তবে সেই সময়ই বিতর্ক আর থিয়েটারে ছিল তার প্রবল আগ্রহ, যার প্রভাব তার রাজনৈতিক জীবনেও স্পষ্ট। পরিচিতজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই বয়স থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, টানা চার দশক ধরে ‘নবরাত্রি’র (উত্তর ভারতে পালিত হিন্দুদের একটি উৎসব) সময় উপবাস করছেন তিনি।
তার পরিবারও ছিল একেবারে সাদামাটা। কৈশোরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন মোদি। পরে কাজ করেছেন গুজরাট রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির ক্যান্টিনবয় হিসেবে। তারা যে বাড়িতে বাস করতেন তাতে আলো-বাতাস ঢোকার সুযোগ ছিল খুবই কম। সেখানে জ্বলতে থাকা একমাত্র বাতিটি নিরন্তর জোগান দিত ধোঁয়া আর কালি।
নির্বাচনের আগে তার এই অতীত টেনে এনে কংগ্রেস শিবির থেকে অপপ্রচার চালানো শুরু করলেও মোদির জন্য তা শাপে বর হয়েছে। তার প্রার্থিতাকে সমর্থন দিয়ে মনোনয়নপত্রে সই করেন এক চাওয়ালা, যা তাকে শ্রমজীবী ভোটারদের নজর কাড়তে সাহায্য করে।
ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী, ১৭ বছর বয়সেই যশোদাবেন নামের এক বালিকার সাথে বিয়ে হয় মোদির। তার জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, সেই সংসার ছিল মাত্র তিন বছরের, শারীরিক সম্পর্কও তাদের ছিল না। বিয়ের বিষয়টি গোপন করার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত মোর্চা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) ‘প্রচারক’ পদ। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আট বছর বয়স থেকেই রাষ্ট্রীয় সংগঠনটির সাথে যুক্ত ছিলেন মোদি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার সময়ও তিনি প্রচারক হিসেবে এর সাথে ছিলেন।
বিষয়টি গোপনীয়তা বজায় না রাখলে হয়তো ওই পদে আসীন হতে পারতেন না তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই মোদির অর্চনার বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। তিনি প্রায়ই পরিবার থেকে বেরিয়ে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে উপাসনা করতেন। কখনো তাকে দেখা যেত হিমালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে। ১৯৬৭ সালে চূড়ান্তভাবে পরিবারের সঙ্গ ত্যাগ করেন তিনি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএসে যোগ দেন মোদি। উগ্র সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনটি এ পর্যন্ত তিন দফা নিষিদ্ধ হলেও মোদির জন্য তা কোনো সমস্যা ছিল না। কিছুদিন পরই সংগঠনটির দিল্লির কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে তার অনেকগুলো কাজের মধ্যে ছিল ভোর চারটায় ঘুম থেকে ওঠা, নাশতার জন্য চা তৈরি এবং কোনো কোনো সময় জ্যেষ্ঠ সতীর্থদের জন্য হালকা নাশতা তৈরি। ওই সময় আরএসএসে আসা বিভিন্ন চিঠির উত্তরও দিতেন তিনি। বাসন- কোসন মাজা, ঝাড়– দেয়া ছাড়াও সমগ্র ভবন পরিষ্কার করতেন মোদি। এর পাশাপাশি নিজের পোশাক-আশাকও তাকেই ধুতে হতো।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ধরপাকড় শুরু করলে আত্মগোপনে যান মোদি। এর দশ বছর পর আরএসএস-এর সিদ্ধান্তে ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।
১৯৯৫ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে মোদি ছিলেন বিজিপির অন্যতম কৌশলপ্রণেতা, তখন তিনি দলের গুজরাট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই সাফল্যের পর অন্যান্য নির্বাচনেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৮ সালে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে মোদিই প্রথম ‘প্রচারক’, যিনি মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেশটির সবচেয়ে উন্নত গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। অথচ এর আগে প্রশাসন চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। তবে মোদির সমালোচকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক জীবনে তার উত্থানের পথে সহায়তাকারীদের ছুঁড়ে ফেলেছেন তিনি। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন বিজেপির অন্যতম তারকা রাজনীতিক লালকৃষ্ণ আদভানি। প্রায় অচেনা মোদিকে তিনিই আজকের অবস্থানে এনেছিলেন। এরপর আরো তিন দফা তিনি রাজ্যটির শীর্ষ পদে বিজয়ী হয়েছেন, গুজরাটকে পরিণত করেছেন বিজেপির ভাষায় উন্নয়নের মডেলে।
গুজরাটের দাঙ্গা, হিন্দুত্ববাদ
২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা স্টেশনে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন দেয়া হলে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার জন্য মুসলমানদের দায়ী করে গুজরাটে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ চালায় হিন্দুত্ববাদীরা। টানা কয়েক দিনের দাঙ্গায় বিপুলসংখ্যক  মানুষের মৃত্যু হয়।
মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিলেন। তিনি নিজে কখনো ওই অভিযোগ স্বীকার করেননি। আদালতও তাকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে রাজ্যসভা নির্বাচনে মোদি কার্যত দাঙ্গার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং হিন্দুত্ববাদের ধুঁয়া তুলে ছিনিয়ে নিয়েছেন জয়।
ওই দাঙ্গার পর ভারত ও ভারতের বাইরে মোদির ভাবমূর্তি দারুণভাবে ুণœ হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে, যুক্তরাজ্যের সাথেও তিক্ততা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে কৌশলী প্রচার শুরু করেন তিনি।
২০০৭ সালের পর তিনি নিজেকে তুলে ধরতে শুরু করেন সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদি’। আর এই চেষ্টায় তিনি যে পুরোপুরি সফল, তার প্রমাণ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন।
তারুণ্যে কুর্নিশ, অভিনব প্রচার
গত বছর জুনে বিজেপি যখন প্রধানমন্ত্রী পদে তাদের প্রার্থী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির নাম ঘোষণা করে, এনডিএ জোটের অন্যতম শরিক জনতা দল (ইউনাইটেড) নিজেদের সরিয়ে নেয় এই আশঙ্কায় যে মোদিই হয়ত নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হবেন।
তবে সব আশঙ্কাকে মোদি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন তরুণদের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে। দলের প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পরপরই তিনি ভারতের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অগ্রসর তরুণদের সাথে বসেন, নির্বাচনী প্রচারের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে মোদি কার্যত বিজেপির দিল্লিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় তারুণ্যের পরিবর্তনকামী মানসিকতাকেই কুর্নিশ করেন। হলোগ্রাম থেকে হোয়াটসঅ্যাপ- সর্বত্র চলে মোদির পক্ষে অভিনব প্রচার।
কৌশলী প্রচার মোদিকে দিয়েছে উন্নয়নের অগ্রদূতের ভাবমূর্তি, বিপুল জনসমর্থন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদি পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ। সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের। হাজার হাজার কর্মী সমর্থক মোদির মুখোশ পরে এ সব জনসভায় হাজির হয়েছেন। সারা ভারতে এক হাজার স্টল থেকে ভোটারদের মাঝে বিলি করা হয়েছে ‘মোদি চা।’
কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হলেও এবারের নির্বাচনে হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন মোদি। যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি পুরো ভারতকে বদলে দেবেন। ভারতকে কখনো মাথা নোয়াতে দেবেন না।
অবশ্য উচ্চাকাক্সী মোদীর সমালোচনাও ছিল অনেক। বলা হয়েছে, তিনি স্বৈরাচারী মেজাজে দল চালাতে চান, প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি মানেন না। মোদির শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে বিরোধী শিবিরে। বলা হয়েছে, দাঙ্গার কলঙ্ক আড়াল করতেই মোদি উন্নয়নের ফাঁপা বুলি আওড়াচ্ছেন। 
কিন্তু তা কাজে লাগেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক নরসিমা রাও বলেন, ‘মোদি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি একেবারেই সৎ। আর ভীষণ পরিশ্রমী। পরিণতির কথা ভেবে কোনো কিছুতেই ছাড় দেননি তিনি। সাময়িক জয়ের মোহে কখনোই মোদিকে বাধা যায়নি।’
বর্তমানে সেই মোদিই উন্নয়ন ও সুশাসনে দলীয় সামর্থ্যরে প্রতীক। বিপুল মধ্যবিত্ত তাকে সমর্থন জোগাচ্ছে। তার ‘আমিও পারি’ নীতি অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছে। আর এরই ফল হিসেবে এক দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিজেপি তাকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দেয়। তিনি ভালোভাবেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন।
সূত্র : ডয়চে ভেল, এএফপি, জি নিউজ ও অন্যান্য মাধ্যম।

No comments:

Post a Comment